বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ, সংঘাত এবং পারমাণবিক উত্তেজনা দিন দিন নতুন মাত্রা নিচ্ছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ইতোমধ্যে তৃতীয় বছরে পা দিয়েছে, আর মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের প্রতিদিনের বোমা হামলায় গাজা উপত্যকা রক্তাক্ত হচ্ছে। এরই মধ্যে ইরানকে হামলার হুমকি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে ১২ এপ্রিল ২০২৫, আন্তর্জাতিক কূটনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ দিন হয়ে উঠতে চলেছে।
ওই দিন ওমানের রাজধানী মাসকাটে মুখোমুখি বসতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান। মূলত ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের এই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে ওমানের মধ্যস্থতায়।
গণমাধ্যমের সূত্রে জানা যায়, এই আলোচনাকে ঘিরেও বাড়ছে উদ্বেগ। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি আলোচনায় উত্তেজনা প্রশমিত না হয়, তাহলে শুরু হতে পারে নতুন এক স্নায়ুযুদ্ধের অধ্যায়—যা শেষ পর্যন্ত রূপ নিতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই আলোচনাকে সরাসরি ‘ডাইরেক্ট ডিসি ফ্যান হাই স্পিড স্ট্রাইকস’ বলে উল্লেখ করে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন—আলোচনা ব্যর্থ হলে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেবে। ইরান পাল্টা বক্তব্যে বলেছে, এটি কোনও সরাসরি আলোচনা নয়, বরং ওমানের মধ্যস্থতায় পরোক্ষ সংলাপ।
২০১৫ সালের ঐতিহাসিক পারমাণবিক চুক্তি থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের একতরফা সরে যাওয়ার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে যে অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে, তা এখনও কাটেনি। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থা (IAEA) জানিয়েছে, ইরান ৮৩ শতাংশ মাত্রার ট্রেস ইউরেনিয়াম উৎপাদনের প্রমাণ পেয়েছে, যা ৯০ শতাংশ স্পর্শ করলেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির উপযুক্ত হয়ে ওঠে।
যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, ইরানের পরমাণু অবকাঠামো সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতে হবে। কিন্তু ইরান বলছে, পারমাণবিক প্রযুক্তি অর্জন ও ব্যবহার তাদের সার্বভৌম অধিকার।
গণমাধ্যমের সূত্রে আরও জানা যায়, এই সংকটকে ঘিরে সবচেয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে ইসরায়েল। তেল আবিব স্পষ্ট করে জানিয়েছে, যদি আলোচনার মাধ্যমে ইরান নিষেধাজ্ঞা থেকে ছাড় পায়, তবে তারা এককভাবেই ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত। ইসরায়েল আশঙ্কা করছে, ইরান অর্থনৈতিক ছাড় পেলে হিজবুল্লাহসহ অন্যান্য প্রক্সি গোষ্ঠীগুলোকে আরও শক্তিশালী করবে।
ইতিপূর্বে, ২০২১ সালের এপ্রিলে ইরানের একটি পারমাণবিক কেন্দ্রে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে যার জন্য ইরান সরাসরি ইসরায়েলকে দায়ী করে। এছাড়া, ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে পাঁচজন শীর্ষ ইরানি পারমাণবিক বিজ্ঞানী হত্যাকাণ্ডের শিকার হন, যা নিয়েও ইসরায়েলের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোর অবস্থানও স্পষ্ট হচ্ছে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সরাসরি যুদ্ধ চায় না, তবে তারা চায় ইরান যেন চাপে থাকে। কারণ যুদ্ধ শুরু হলে প্রথম দিকের আঘাত তাদের ভূখণ্ডে পড়তে পারে। অন্যদিকে ওমান ও কাতার আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান চায়, যাদের অর্থনীতি ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, বিশ্বজুড়ে আরও দেশ পারমাণবিক শক্তি অর্জনের চেষ্টা করছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও সতর্ক করে বলেছেন, বিশ্ব এখন ইতিহাসের সবচেয়ে বিভক্ত অবস্থায় রয়েছে। বড় শক্তিগুলোর মধ্যে সমন্বয় না হলে, এই বিভাজন ধ্বংস করে দিতে পারে পুরো মানবসভ্যতাকে।
বিশ্লেষকদের মতে, ১২ এপ্রিল মাসকাটে অনুষ্ঠিতব্য ইরান-যুক্তরাষ্ট্র বৈঠক কেবল পারমাণবিক উত্তেজনা প্রশমনের একটি উদ্যোগ নয়, বরং এটি হতে পারে পৃথিবীকে আরেকটি মহাযুদ্ধের পথ থেকে ফেরানোর শেষ সুযোগ।