৫৩টি পরিবহন টার্মিনাল থেকে মাসে সাড়ে ৬৬ কোটি টাকারও বেশি চাঁদা

রাজধানীতে ৫৩টি পরিবহন টার্মিনাল ও স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন দুই কোটি টাকার বেশি চাঁদাবাজি হচ্ছে। গোয়েন্দার এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। গোয়েন্দাদের ভাষ্যমতে, সরকার পরিবর্তনের পর রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় বিভিন্ন পরিবহন টার্মিনাল ও স্ট্যান্ডে প্রতি মাসে সাড়ে ৬৬ কোটি টাকার বেশি চাঁদাবাজি চলছে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, চাঁদাবাজি বাড়ার তথ্য পেয়ে তা যাচাই করছে তারা। সেই সঙ্গে দেশের সব টার্মিনাল ও স্ট্যান্ডের পাশাপাশি মার্কেটেও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে পোশাক ও সাদা পোশাকে কাজ করছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা।

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্র বলছে, ঈদকে সামনে রেখে রাজধানীর বিভিন্ন টার্মিনালকেন্দ্রিক প্রতিদিন কোটি টাকার বেশি চাঁদাবাজির তথ্য পেয়েছে তারা। আবার দেশের পরিবহন খাতে মাফিয়াদের লাগামহীন চাঁদাবাজির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য দুদকের তদন্তেও উঠে এসেছে।

গোয়েন্দা সূত্র বলছে, পরিবহন সাম্রাজ্য থেকে চাঁদাবাজির অবৈধ টাকা পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিদেশে পলাতক মাফিয়াদের কাছে।

বিদেশে পলাতক থাকা কিছু শীর্ষ সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে এ ধরনের তথ্য পেয়ে তদন্ত অব্যাহত রেখেছে তারা।

টার্মিনালে চলমান চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) নজরুল ইসলাম রোববার (৯ মার্চ) গণমাধ্যমকে বলেন, ঢাকায় টার্মিনালকেন্দ্রিক চাঁদাবাজির তথ্য পেয়ে যাচাই চলছে।

পুলিশ বলছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির নামের পাশাপাশি সমিতির নামেও চাঁদাবাজির তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কিছু অসাধু ব্যক্তির বিরুদ্ধেও চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ও তদন্তে গুরুত্ব পাচ্ছে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানীতে ৫৩টি পরিবহন টার্মিনাল ও স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন দুই কোটি টাকার বেশি চাঁদাবাজি হচ্ছে। সেই হিসাবে প্রতি মাসে সাড়ে ৬৬ কোটি টাকার বেশি চাঁদাবাজি হয়।

এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগে সাবেক সরকারের লোকজন চাঁদাবাজিতে জড়িত ছিল। এ জন্য টোকেন, রসিদ ও স্টিকার ব্যবহার করত তারা।

হাত বদলের পর এখন নানা কৌশলে চাঁদাবাজি চলছে। এখন ধরা পড়ার ঝুঁকি এড়াতে চাঁদাবাজরা নৈশপ্রহরী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও লাইনম্যানের বেতন পরিষদের নামে অভিনব পদ্ধতিতে চাঁদাবাজি করছে। চাঁদার টাকার লেনদেন হচ্ছে নগদ ও বিকাশ ব্যবহার করে।

দীঘদিন ধরে টার্মিনালের পর কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন মার্কেট ও ফুটপাতকেন্দ্রিকও চাঁদাবাজি চলছে। এত কিছুর পরও কার্যত চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মহাখালীসহ আশপাশের সড়কগুলোতেও চাঁদাবাজি চলছে। গাবতলী ও তেজগাঁও টার্মিনালকেন্দ্রিকও চাঁদাবাজি চলছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, চাঁদাবাজিসহ সব অপরাধ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর সূত্র বলছে, গত ১১ ফেব্রুয়ারি জনপথ অধিদপ্তরে এ ধরনের একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগের শাসনামলে চাঁদাবাজির একটি ব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন দলটির নেতাকর্মীরা। সে সময় একটা টোকেন ব্যবহার করে চাঁদাবাজি করতেন তাঁরা। সেটির চিহ্ন রয়ে যেত কাগজে। সরকার পতনের পর বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা এই ব্যবস্থা দখলে নেন। তাঁদের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও চাঁদাবাজি করছেন।

বর্তমানে রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকায় বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, পিকআপ, হিউম্যান হলার (লেগুনা) এবং অটোরিকশাসহ ৯৫ ধরনের টার্মিনাল এবং স্ট্যান্ড রয়েছে জানিয়ে গোয়েন্দা সূত্র বলছে, এর মধ্যে রাজধানীতেই রয়েছে ৬৬টি টার্মিনাল ও স্ট্যান্ড। এর মধ্যে আন্ত জেলা বাসস্ট্যান্ড ও ৩৭টি লেগুনা স্ট্যান্ড রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে সাতটি স্থানীয় বাসস্ট্যান্ড, পাঁচটি পিকআপ স্ট্যান্ড, চারটি স্থানীয় ও চারটি অটোরিকশা স্ট্যান্ড, তিনটি আন্ত জেলা বাস টার্মিনাল, তিনটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা স্ট্যান্ড, দুটি ট্রাক স্ট্যান্ড এবং একটি মাইক্রোবাস স্ট্যান্ড।

ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, দৈনিক দুই কোটি ২১ লাখ টাকার চাঁদাবাজির মধ্যে এক কোটি ১৭ লাখ টাকা চাঁদাবাজি হয় পরিবহন মালিক সমিতির নামে। সংস্থার পক্ষ থেকে এমন ১১ ধরনের পেমেন্টের প্রমাণ পাওয়া গেছে জানিয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, দূরপাল্লার ও মাঝারি পাল্লার বাস, ট্রাক, পিকআপ এবং কাভার্ড ভ্যান, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, হিউম্যান হলার, সিএনজিচালিত অটোরিকশা এমনকি রিকশা থেকেও দুর্বৃত্তরা চাঁদাবাজি করছে।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু গতকাল গণমাধ্যমকে বলেন, বিএনপিতে চাঁদাবাজদের কোনো জায়গা নেই। কেউ যদি এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়ায়, তার দায় বিএনপি নেবে না।

Scroll to Top