দীর্ঘদিন ধরে ভারতের একচেটিয়া স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশে চাপিয়ে দেওয়া একের পর এক তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্প। কৌশলগত ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ভারতীয় প্রভাবের কারণে বাংলাদেশের পূর্ববর্তী সরকারগুলো সেসব প্রকল্প মেনে নিতে বাধ্য ছিল। তবে ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর দৃশ্যপট পাল্টে যায়। নতুন নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার প্রধান হিসেবে আছেন বিশ্বনন্দিত অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ ইউনুস।
নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়েই জানিয়ে দেয়, দেশের স্বার্থবিরোধী কোনো প্রকল্প আর চলবে না। নতুন সরকারের কাছ থেকে ভারতের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু বড় প্রকল্প বাতিলের ঘোষণা আসে।
এসব প্রকল্পের মধ্যে প্রথমেই আসে ভারতের ত্রিপুরা-চট্টগ্রাম রেল সংযোগ, ভারতের একচেটিয়া সুবিধার জন্য ত্রিপুরা হয়ে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের রেল সংযোগ স্থাপনের পরিকল্পনা ছিল, বাংলাদেশ বিনামূল্যে এই ট্রান্সিট সুবিধা দিতে বাধ্য হয়, প্রকল্পটি ছিল বাংলাদেশের কৌশলগত স্বার্থের জন্য বড় হুমকি।
দ্বিতীয়ত, অভয়পুর-আখাউড়া রেলপথ সম্প্রসারণ, ভারতের সামরিক ও বাণিজ্যিক রসদ পরিবহনের সুবিধার্থে এই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, যা বাংলাদেশের কৌশলগত নিরাপত্তার জন্য ছিল হুমকি।
এছাড়া আশুগঞ্জ-আগরতলা করিডর ভারতীয় পণ্য পরিবহনে ব্যবহারিত হলেও, বাংলাদেশের খরচে নির্মাণ করা হয় এই রাস্তা, এসব প্রকল্প বাতিল করে দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এসব প্রকল্পে আরও রয়েছে ফেনী নদী জল ব্যবস্থাপনা প্রকল্প, ফেনী নদীর পানি ব্যবহারের অধিকার নিয়ে ভারত বরাবর বাংলাদেশকে চাপে রেখেছিল, অথচ ভারতের ভূখণ্ডে এই নদীর উৎস না থাকা সত্ত্বেও ভারত জোর করে পানি নিয়ে যাচ্ছিল, এই চুক্তি পুনর্বিবেচনার ঘোষণা দিয়ে প্রকল্প বাতিল করা হয়।
এছাড়া কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির অনুসারী প্রকল্প, ভারতের চাপ ছিল বাংলাদেশের অংশ থেকে আরও পানি উত্তোলন করবে তারা, কিন্তু দেখা যায় এই পানি বণ্টনের কোনো বাস্তব সমন্বয় হয়নি, বাংলাদেশের কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল, তাই বাংলাদেশ সরকার এই প্রকল্প বাস্তবায়ন বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়।
এর মধ্যে আরও ছিল বন্দর ব্যবহারের চুক্তির আওতাভুক্ত সড়ক ও নৌপথ উন্নয়ন প্রকল্প, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ভারতের জন্য উন্মুক্ত করতে বাংলাদেশকে চাপ দিয়ে একাধিক সড়ক, ব্রিজ ও টার্মিনাল উন্নয়নের জন্য প্রকল্প নেয়া হয়েছিল, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা।
এছাড়া ফারাক্কাবাদ সংস্কার প্রকল্পের সহায়তা, ভারত চেয়েছিল বাংলাদেশ নিজেদের অর্থ দিয়ে ভারতীয় অঞ্চলের ফারাক্কাবাদের সংস্কারের সহযোগিতা করবে, অথচ এই ফারাক্কাবাদই বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের শুকিয়ে মারছে, আর তাইতো এ ধরনের সহযোগিতা এই সরকার প্রত্যাখ্যান করে।
সিলেট-শিবচর সংযোগ প্রকল্প, এই সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে সরাসরি প্রবেশ করতে চেয়েছিল, কৌশলগত দিক থেকে এটি ছিল অত্যন্ত বিপদজনক, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিরাপত্তা ঝুঁকি চিহ্নিত করে এই প্রকল্পটি বাতিলের সুপারিশ করে এবং সরকার দ্রুত কার্যকর করে।
প্রকল্প বাতিলের তালিকায় আরও রয়েছে পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন সম্প্রসারণ প্রকল্প, ভারতের ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশের জ্বালানি সরবরাহের নামে একটি পাইপলাইন তৈরি করা হয়েছিল, যার মাধ্যমে ভারত দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের জ্বালানি বাজার দখল করতে চেয়েছিল।
তবে এসবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের চুক্তির নতুন ধারা, ভারত চেয়েছিল এই দুই বন্দর দীর্ঘমেয়াদে তাদের একচেটিয়া ব্যবহার নিশ্চিত করতে।
বাংলাদেশের এই কঠোর অবস্থানে কাঁপন ধরে মোদি প্রশাসনে। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নানা ধরনের মিথ্যা প্রচারণা শুরু হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের এই পদক্ষেপ শুধু একটি রাষ্ট্র হিসেবে আত্মমর্যাদার প্রতিফলন নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতেও বড় পরিবর্তনের বার্তা।