পাচারের টাকা ফেরাতে যুক্তরাজ্যে তৎপর প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস

পতিত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে দেশ থেকে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। সরকারি দপ্তরের তথ্যে বলা হচ্ছে, গত ১৫ বছরে বিভিন্ন ব্যাংক দখল করে ভুয়া ঋণগ্রহণ এবং সরকারি প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হয়েছে এসব টাকা। এখন পাচার অর্থ ফেরত আনতে সংশ্লিষ্ট দেশে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।

সরকারি তথ্যমতে, দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে যুক্তরাজ্যে। সেসব অর্থ উদ্ধারে যুক্তরাজ্য সরকারকে নৈতিকভাবে সহায়তার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ইতিমধ্যে অর্থ পাচারে জড়িত রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী সেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ১১টি অগ্রাধিকারমূলক তদন্ত শেষে মামলার প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। একই সঙ্গে বিদেশে আইনপ্রয়োগকারী ও আইন সহায়তাকারী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে।

বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ও কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিসহ যুক্তরাজ্যে সফরে আছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর অর্থ উদ্ধারে ‘লিটিগেশন ফান্ডিং’ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। প্রয়োজনে গুরুত্ব বিবেচনায় পাচারকারিদের সঙ্গে সমঝোতার কথা চিন্তা করছেন তিনি। তবে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতাকে বড় একটি চ্যালেঞ্জ মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

শুধু যুক্তরাজ্য নয়; যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ক্যামেন আইল্যান্ড এবং ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে অর্থ পাচার হয়েছে। লিটিগেশন ফান্ডিং আইনি সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান। তারা আইনজীবী ও আদালতের খরচসহ দেওয়ানি মামলার যাবতীয় ব্যয় বহন করে। বিনিময়ে মামলা জয়ী হলে নিষ্পত্তির অর্থ থেকে একটি অংশ পেয়ে থাকে প্রতিষ্ঠানগুলো।

সরকারের পদক্ষেপের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে যুক্তরাজ্য সরকারের সঙ্গে নেওয়া যৌথ প্রচেষ্টা বাংলাদেশ জোরদার করেছে। পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার একটি দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল প্রক্রিয়া। তাই এ কাজে গতি আনতেই অন্তর্বর্তী সরকার প্রচেষ্টা আরও জোরদার করেছে।

লন্ডনে এক সংবাদ সম্মেলনে শফিকুল আলম বলেছেন, পাচার হওয়া সম্পদ ফেরাতে সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইমস এজেন্সির (এনসিএ) সঙ্গে বৈঠক করেছেন দুদক চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। পাচারের অর্থ শনাক্ত, কীভাবে পাচার হয়েছে তা খুঁজে বের করা ও জব্দ করার বিষয়ে সংস্থাটির ভালো অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে তারা দুটি পদক্ষেপও নিয়েছে। পাচারকৃত অর্থ কীভাবে ফেরত আনা যায়, তা জানতে অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতাও যাচাই করা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জনাথন পাওয়েলের সঙ্গেও এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে অভিযুক্তদের সঙ্গে ‘সমঝোতার’ ইঙ্গিত দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। ব্রিটিশ গণমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন। গভর্নর বলেছেন, বিদেশে অর্থ পাচারের যেসব মামলা রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম গুরুতর মামলাগুলোর ক্ষেত্রে আর্থিক সমঝোতা অন্যতম বিকল্প হতে পারে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কথিত কার্যকলাপের প্রকৃতির ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ নির্ভর করবে। যদি আইন লঙ্ঘনের প্রকৃতি তুলনামূলকভাবে হালকা ধরনের হয়, তবে আমরা দেওয়ানি মামলা করব। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আর্থিক সমঝোতার কথা বিবেচনা করা হবে।

এদিকে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার চেষ্টায় যুক্তরাজ্যে সফররত প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সঙ্গে সাক্ষাতে আগ্রহ দেখাননি দেশটির প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে এমন তথ্য এসেছে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে স্টারমারের সমর্থন আদায়ের জন্য প্রধান উপদেষ্টা এ সফর করছেন বলে জানা গেছে। তবে কিয়ার স্টারমার বাংলাদেশের এ প্রচেষ্টাকে সমর্থন জানাবেন বলে আশা করছেন অধ্যাপক ইউনূস। এর মধ্যেই ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘নৈতিক’ বোধ থেকে যুক্তরাজ্যের উচিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পাচার হওয়া অর্থ খুঁজে বের করতে সহায়তা করা। ইতিমধ্যে অর্থ খুঁজে পেতে তারা সহায়তা করছে। এ সফরের উদ্দেশ্য ছিল যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে আরও জোরালো সমর্থন নিশ্চিত করা।

অধ্যাপক ইউনূস জানিয়েছেন, আগামীতে যুক্তরাজ্য আরও সফরের পরিকল্পনা রয়েছে। তার প্রশাসন যুক্তরাজ্যের ব্যবসা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাসহ সব দিক থেকে সহায়তা পেতে চাইছে। পাশাপাশি ব্রিটেনের জনগণের সমর্থন চেয়েছেন তিনি।

জানা যায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোনের মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক কিয়ার স্টারমারের ঘনিষ্ঠ মিত্র। তার খালার সঙ্গে আর্থিক কেলেঙ্কারি জের ধরে গত জানুয়ারিতে সিটি মিনিস্টারের পদ ছাড়তে বাধ্য হন টিউলিপ।

অর্থ পাচার ও উদ্ধারের বিষয় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, যেসব দেশে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়েছে, তার মধ্যে যুক্তরাজ্য অন্যতম একটা বড় জায়গা। ব্রিটেনের আইনি কাঠামোর সঙ্গে আমাদের আইনি কাঠামোরও অনেক মিল আছে ঔপনিবেশিক কারণে। সে কারণে উদ্যোগটা সেখান থেকেই শুরু হয়েছে। তবে আইনের সঙ্গে মিল থাকলেও পাচারকৃত অর্থের সঙ্গে যোগসূত্রতা নির্ধারণ করা বড় চ্যালেঞ্জ। পাচারের অর্থ ফেরত আনতে যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন কোম্পানিও রয়েছে। তারা বিভিন্ন দেশের সরকারের অনুরোধে অর্থ ফেরানোর কাজ করে থাকে। যুক্তরাজ্য থেকে এ অর্থ ফেরাতেও সেসব কোম্পানির সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন রয়েছে।

দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেছেন, এ অর্থ যে অবৈধভাবে পাচার হয়েছে, তারপর লগ্নি হয়েছে, এটা কিন্তু আদালতে প্রমাণ করতে হবে। এ পক্রিয়ায় গড়ে পাঁচ থেকে সাত বছর সময় লাগে। কিন্তু আমাদের চাপ তো অব্যাহত রাখতে হবে। প্রধান উপদেষ্টার এ সফরে যারা সঙ্গী রয়েছেন, তাদের এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যকে আরও ভালোভাবে রাজি করিয়ে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নিতে হবে।

যুক্তরাজ্যে পাচার হওয়া অর্থ বাংলাদেশকে ফিরিয়ে দিতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি। গত মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সন্দেহভাজন অর্থ পাচারকারী, দুর্নীতি ও চৌর্যবৃত্তির সঙ্গে জড়িতদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং যুক্তরাজ্যে পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধারে দেশটির সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানাই।

বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাষ্ট্রসংস্কারের চলমান উদ্যোগ, বিশেষ করে দুর্নীতির কার্যকর নিয়ন্ত্রণের অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে পাচার হওয়া সম্পদ বাংলাদেশকে ফিরিয়ে দিতে যুক্তরাজ্যকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। এর মাধ্যমে এমন জোরালো বার্তা দিতে হবে যে, চূড়ান্ত বিবেচনায় অর্থ পাচারকারীদের শুধু উৎস হিসেবে বাংলাদেশই নয়, গন্তব্য দেশ যুক্তরাজ্যেও কার্যকরভাবে জবাবদিহি করতে হয়।

গণমাধ্যমে পাঠানো ওই বিবৃতিতে স্পটলাইট অন করাপশনের নির্বাহী পরিচালক সুসান হাওলি বলেছেন, ‘সময় অপচয় না করে তাৎক্ষণিকভাবে যুক্তরাজ্য সরকারের উচিত বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ জব্দে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ ও অর্থ পুনরুদ্ধারে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে।

বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, দ্য অবজারভার ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ইউকের তদন্তে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজনদের যুক্তরাজ্যে মালিকানাধীন কমপক্ষে ৪০০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের সম্পত্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) ইতিমধ্যে ৯০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের সম্পদ জব্দ করেছে।

বিবৃতিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ইউকের পলিসি ডিরেক্টর ডানকান হেমস বলেন, বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজনদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে অর্জিত (বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত) যুক্তরাজ্যে ৪০০ মিলিয়ন পাউন্ড সম্পদের যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, যথাযথভাবে অনুসন্ধান করে যুক্তরাজ্য সরকারকে তা জব্দ করতে হবে।

Scroll to Top