দুহাত পেছনে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে তোলা হলো আনিসুল-সালমানদের

এতদিন এক হাতে হাতকড়া পরানো অবস্থায় আদালতে তোলা হতো গ্রেপ্তার হওয়া আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীদের। বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) আদালত পাড়ায় দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদসহ আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতাকে দুই হাত পেছনে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে।

সকাল ১০ টার দিকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে তাদের তোলা হয়। হেলমেট, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও হ্যান্ডকাফ পরিয়ে হাজতখানা থেকে তাদের বের করা হয়। হাজতখানার ভেতর থেকে মাথা নিচু করে বের হয়ে আসেন সালমান এফ রহমান। তার পরনের ছিল সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি। মাথায় পুলিশের হেলমেট। বুকে পুলিশের বুলেট প্রুফ জ্যাকেট। হাত দুখানা পেছনে মোড়ানো। দুই হাতেই হাতকড়া (হ্যান্ডকাফ)।

সালমানের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। তার মাথায় হেলমেট, বুকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট। তার হাত দুখানাও পেছনে ছিল। তবে তার দুই হাতে হাতকড়া পরানো ছিল না। শুধু বাঁ হাতে ছিল হাতকড়া। আর ডান হাত তিনি বা হাতের ওপরে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যান। মামুনের পেছনে ছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তার পরনে ছিল আকাশি রঙের পাঞ্জাবি। তার দুই হাত পেছনে ছিল। দুই হাতেই পরানো ছিল হাতকড়া। আনিসুলের পেছনে ছিলেন সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ। তার মাথায় হেলমেট, বুকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট। তাঁর দুই হাতও পেছনে ছিল। পরানো ছিল হাতকড়া।

নুরুজ্জামানের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন সাবেক বন ও পরিবেশ উপমন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব। তার দুই হাতও পেছনে ছিল। তবে তার এক হাতে পড়ানো ছিল হাতকড়া। জাকবের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সাবেক সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের মাথায় ছিল হেলমেট। বুকে বুলেট প্রুফ জ্যাকেট। তার এক হাতে হাতকড়া পড়ানো ছিল। দুজন পুলিশ সদস্য তার দুই হাত ধরে সামনের দিকে হাঁটছিলেন। এদিন একই সময়ে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিকে দুজন নারী পুলিশ সদস্য তাকে হাত ধরে হাজতখানার বাইরে নিয়ে আসেন। এরপর সালমান, আনিসুল, নুরুজ্জামানদের আদালত ভবনের নিচতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে হাঁটিয়ে দুই তলায় ওঠানো হয়। তারপর তাদের একে একে আসামির কাঠগড়ায় তোলা হয়।

কাঠগড়ায় তোলার পর আনিসুল, সালমান ও নুরুজ্জামানের হাতকড়া খোলা হয়। যখন পুলিশ তাদের হাতকড়া খুলছিল, তখন তিনজনেরই মুখ ছিল নিচের দিকে। হাতকড়া খোলার পর বিমর্ষ মুখে সালমান তার আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। আদালতে তোলার পর হাজি সেলিমের হেলমেট খুলে দেয় পুলিশ। এরপর তাদের বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার দেখানোর শুনানি শুরু হয়। এসময় শুনানির পুরোটা সময় ধরে সালমান এফ রহমান নিজের দাড়ি ডান হাত দিয়ে ধরে মুখে নিয়ে কামড়াতে থাকেন। শুনানির শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের দাড়ি হাত দিয়ে ধরে কামড়াতে থাকেন।

শুনানিতে যাত্রাবাড়ী থানার হত্যা মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা তাকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করলে আদালত আবেদন মঞ্জুর করেন। পরে যাত্রাবাড়ী থানার পৃথক কয়েকটি মামলায় সালমান এফ রহমানসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। অন্যদিকে যাত্রাবাড়ী থানার পৃথক দুই হত্যা মামলায় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে ৬ দিন, সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুনকে এক হত্যা মামলায় ৩ দিন রিমান্ড নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন আদালত।

গ্রেপ্তার দেখানো অন্যরা হলেন- সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহম্মেদ, পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, গুলশান থানার সাবেক ওসি মাজহারুল ইসলাম, ভোলা- ২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলী আজম মুকুল, ভোলা- ৪ আসনের সাবেক এমপি আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, ঢাকা- ৭ আসনের সাবেক এমপি হাজী মোহাম্মদ সেলিম।

আনিসুল-সালমান-দীপুর কথোপকথন

আনিসুল-সালমানদের কাঠগড়ায় তোলার পর সারিবদ্ধভাবে কয়েকজন পুলিশ সদস্য তাদের সামনে দাঁড়ান। তখনো বিচারক এজলাসে আসেননি। সালমান তার আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। পাশে দাঁড়ানো আনিসুলও তার আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। তবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন দীপু মনি।

দীপু মনির ডান পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন নুরুজ্জামান। নুরুজ্জামানের বাম পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন হাজী সেলিম। হাজী সেলিমের দিকে নুরুজ্জামান চেয়েছিলেন। তিনি মুখের ইশারায় হাজী সেলিমের কাছে জিজ্ঞাসা করেন, কেমন আছেন। হাজী সেলিম মুখ নাড়েন।

এ সময় আনিসুলের পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন দীপু মনি। তারা প্রায় দুই থেকে তিন মিনিট ধরে কথা বলতে থাকেন। আনিসুল পরে সালমানের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। এরপর সাবেক আইজিপি মামুনের সঙ্গে কথা বলেন সালমান। প্রায় ১০ মিনিটে ধরে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সালমান, আনিসুল, দীপু মনিরা কথা বলেন। এ সময় একজন পুলিশ সদস্য উঁচু স্বরে বললেন, ‘স্যার (বিচারক) আসছেন’।

‘নির্বাক’আনিসুল

যাত্রাবাড়ী থানায় দায়ের করা জেহাদ হোসেন হত্যা মামলায় আনিসুল ও মামুনকে ১০ দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আজ আদালতে আবেদন করে পুলিশ।

শুনানিতে ঢাকা মহানগর দায়রে জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ঢাকার মধ্যে সব থেকে বেশি আন্দোলন হয়েছে যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া এলাকায়। এ সময় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সংগঠনের সদস্য এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যা করেছে। আর এসব হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং সাবেক আইজিপি মামুন সরাসরি জড়িত। নিরীহ ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে দমাতে পাখির মতো গুলি করে মানুষ হত্যা করা হয়েছে।

পিপির এই বক্তব্যের পর সাবেক আইজিপি মামুনের আইনজীবী আদালতকে বলেন, তার মক্কেলের ইতিমধ্যে ৮৫ দিন রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। তিনি সাবেক পুলিশপ্রধান। কোনো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নন। মামুনের আইনজীবী রিমান্ডের বিরোধিতা করে আদালতে বক্তব্য রাখেন। আনিসুলের পক্ষের আইনজীবী আদালতে উপস্থিত থাকলেও তিনি কোনো বক্তব্য রাখেননি। এ সময় আনিসুল বিচারকের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। শুনানি শেষে এই মামলায় আনিসুল ও মামুনের তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।

এরপর যাত্রাবাড়ী থানায় দায়ের করা ওয়াসীম হত্যা মামলায় আনিসুলের তিন দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। এ সময় পিপি ওমর ফারুক ফারুকী আদালতকে বলেন, আনিসুল হক জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী। এই মামলার শুনানিতেও আনিসুলের আইনজীবীরা রিমান্ডের বিরোধিতা করে কোনো বক্তব্য রাখেননি। আদালত শুনানি নিয়ে আনিসুলের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তখনো নির্বাক আনিসুল বিচারকের দিকে চেয়েছিলেন।

গ্রেপ্তার ও রিমান্ডের শুনানির পর সালমান, আনিসুল ও নুরুজ্জামানদের মাথায় আবার হেলমেট পরানো হয়। কাঠগড়া থেকে সবার আগে বের করা হয় দীপু মনিকে। তার দুই হাত ধরেছিলেন দুজন নারী পুলিশ সদস্য। এরপর একে একে হাজী সেলিম, সালমান, আনিসুল, নুরুজ্জামানদের কাঠগড়া থেকে থেকে আদালতের বারান্দায় নিয়ে আসা হয়। তখন দেখা যায়, আনিসুল, সালমান ও নুরুজ্জামানদের দুই হাত পেছনের দিকে। দুই হাতেই লাগানো হাতকড়া। মাথা নিচু করে আনিসুল, সালমান ও নুরুজ্জামান আদালতের হাজতখানার ভেতরে ঢুকে যান।

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন হয়। ১৩ আগস্ট প্রথম গ্রেপ্তার হন আনিসুল ও সালমান। এরপর তাদের বহুবার আদালতে তোলা হয়েছে। তখন তাদের এক হাতে হাতকড়া পরানো অবস্থায় দেখা গেছে। তারা দুই হাত সামনে রেখে আদালতের কাঠগড়ায় উঠতেন। বুধবারই প্রথম তাদের দুহাতে পেছনে নিয়ে হাতকড়া পরানো অবস্থায় দেখা গেল।

এ প্রসঙ্গে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পিপি ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, আনিসুল, সালমান ও নুরুজ্জামানকে যে পেছনে দুই হাত নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে, সে তথ্য তাঁর নজরে আসেনি। তিনি মনে করেন, এভাবে কোনো আসামিকে আদালতে তোলা উচিত নয়। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ আসামিদের দুই হাতে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে তুলে থাকে।

Scroll to Top